উৎসব

RKM Rahara-01
RKM Rahara-01


শ্রীরামকৃষ্ণের নামাঙ্কিত স্কুল। পড়াশুনার সাথে সাথে চিনতে শিখলাম স্বামীজী, মা সারদা, ভগনি নিবেদিতা, স্বামী ব্রহ্মানন্দ, লাটু মহারাজ থেকে রামকৃষ্ণানন্দজী সহ আরও মনীষীদের। বাংলা অঙ্ক ইংরাজীর সঙ্গে আরও একটা বিষয় আমাদের আগাগোড়া পড়ানো হত, তা হল ভারতীয় সংস্কৃতি। সেখানে শ্রীরামকৃষ্ণ স্বামীজীর কথা, জীবনীর পাশে পাশে উপনিষদের গল্প, গীতার শ্লোক, শঙ্করাচার্য্যের মোহমুদ্গর ইত্যাদি নানা বিষয় পড়তে হত। কতক বুঝে বা না বুঝে, সেই সব কথার কিছু কিছু মনে ভেতর গেঁথে দিয়েছিল, যা পরিণত বয়সে চলার পথে আলো দেখায়। ছেলেবেলায় এই বিষয়টিকে অন্য পড়ার বিষয় হিসেবেই দেখেছি। আর পাঁচটা স্কুলের থেকে আমাদের স্কুলের পরিবেশ নিঃসন্দেহে আলাদা। গাছগাছালিতে ঘেরা আশ্রমিক তপোবন যেন, গৃহত্যাগী সন্ন্যাসীরা চতুর্দিকে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কেউ ক্লাশ নেন তো কেউ পুজো করেন, তো কেউ অফিস দেখাশোনা করেন। আমাদের বেড়ে ওঠা একটা অন্য আবহে। তবে সেখানে খুব বেশি ধর্মচর্চা হয়েছে, বলে কখনও মনে হয়নি। আমাদের মন্দিরে শ্রীরামকৃষ্ণের বিগ্রহের সাথে যীশুর ছবি, কাবার ছবি, বুদ্ধদেবের ছবি একই শ্রদ্ধায় পূজিত হত। আমাদের সাথে কয়েকজন অন্য ধর্মাবলম্বী সহপাঠীও পড়ত। ওই সময় তফাত বোঝার মতো মন ছিল না, বা আমাদের কখনও তফাত বোঝানোও হয়নি। যেমন মনে আছে শিবুদার কথা। নিম্নবুনিয়াদীর সহ প্রধান শিক্ষক। খুব বড় বাড়ির ছেলে। সংসার করেননি। স্কুলের ছেলেদের নিয়েই জীবন কাটালেন। শিবুদা বলতেন, “হয়তো তোদের বাবার ক্ষমতা আছে দামী কাপড়ের জামা কিনে দেবার, কিন্তু আমার আশ্রমের ছেলেদের কে দেবে?” তাই মোটা কাপড়ের পোষাক বরাদ্দ ছিল, আমাদের সকলের জন্যই।

শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মতিথি ফাল্গুন মাসে। ফি বছর ওই দিনটা ঘিরে আমাদের স্কুলে হত এক সপ্তাহব্যপী অনুষ্ঠান। মূল অনুষ্ঠানটা হত আমাদের নিম্নবুনিয়াদী বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গনে। পুরো মাঠ ঘিরে তৈরি হত প্যান্ডেল। যখন সেই প্যান্ডেল বাঁধার বাঁশ পড়তে আরম্ভ করত, আমাদের মনটা খুশিতে লাফিয়ে উঠত। নির্মীয়মান পান্ডেলের বাঁশ ধরে ঝুল খাওয়া ছিল পরম প্রাপ্তি। আর যারা ছিল আরেকটু ডাকাবুকো, তরতর করে এডাল ওডাল করে মগডালে উঠে যেত। প্রতিদিনের অনুষ্ঠানে একটি করে যাত্রা ছিল বাঁধা। আশ্রমের ছেলেরা একদিন করত, স্যারেরা করতেন একদিন, বাইরের প্রতিষ্ঠিত দলও আসত তাদের পালা নিয়ে। যারা পার্ট করত, অনুষ্ঠানের প্রায় একমাস আগে থেকে তাদের মহড়া চলত। কেমন ভিণগ্রহের প্রাণী বলে মনে হত। গোবিন্দ বলে একটি ছেলের কথা মনে পড়ে। আশ্রমে থাকত। আমাদের শ্রেণীতে পড়লেও, চেহারায় বেশ বড়সড় ছিল। ও একবার বোধহয় হিরণ্যকশিপু বা রাবণ হয়েছিল। টিফিন পিরিয়ডে মাঝে মাঝে চোখের কসরত আর অট্টহাসি সহ সংলাপ বলত। আমি তো চিরকেলে হাঁ-করা। সবকিছুতেই বিস্ময়ে হতবাক হতাম। বিশেষ করে গোবিন্দকে যখন রাজপোশাকে মঞ্চে দেখলাম, কী বলব, বড় হয়ে ঠিক হিরণ্যকশিপু বা রাবণ হব বলে ঠিক করে ফেলেছিলাম। দিন্দা স্যার কে মঞ্চে দেখার কৌতুহল ছিল খুব।

এই সপ্তাহটি আমাদের উৎসবের মেজাজ। উৎসব শব্দটি আমাদের বাল্য জীবনে এই অনুষ্ঠান ঘিরে আবর্তিত হত। পরে কথার মধ্যে, কোন বিশেষ আনন্দের অনুষঙ্গেও আমরা উৎসব বা শুধু উৎ শব্দটি ব্যবহার করে আমোদ পেতাম। উৎসব শুরু হত, এক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা সহকারে। এই মিছিলে যোগ দেবার জন্য আমাদের সাতসকালে স্কুলে এসে হাজির হতে হত। মিশনের প্রতিটি বিভাগ থেকে সবাই অংশগ্রহন করত। সে শোভাযাত্রার বহর আর বাহার ছিল দেখবার মতো। আজও একই উদ্দীপনার সাথে শোভাযাত্রা বার হয়। যার মাথাটি প্রায় এক কিলোমিটার এগিয়ে গিয়েছে, অথচ শেষটুকু স্কুল প্রাঙ্গন ছাড়েনি। আমাদের কাজ ছিল, ছোট ছোট প্লাকার্ডে মহাপুরুষদের বাণী লিখে আনা। আর শোভাযাত্রায় সেই প্লাকার্ডটি বয়ে নিয়ে যেতে হত। যারা গান গাইত, তাদের জায়গা হত গানের দলের সাথে। কেউ কেউ স্বামীজী, শ্রীরামকৃষ্ণ, বা রাম লক্ষণ ইত্যাদি বহু মনীষীদের মতো সেজে গুজে রথে চড়ে বসত। তাদের প্রতি শুরুতে প্রচ্ছন্ন ঈর্ষা হত, তবে পরে নিজেদের আনন্দ বিচারে, ওদের জন্য কষ্টই হত। আমরা যেমন খুশি বন্ধুদের সাথে মজা করতে করতে পুরো রাস্তা ঘুরতাম, ওরা বেচারা কাঠের পুতুলটি হয়ে ধরাচূড়া পরে বসে থাকত।

ওই সময়ে খুব বেশি বন্ধুরা গাড়ি চড়ে আসত না। স্কুলের দুটি বড় বাস ছিল, একটি টাটা কোম্পানীর অন্যটি অশোক লেল্যান্ড। যারা বাসে করে যাতায়াত করত, তাদের কাছে ওই বাসের সময়টি ছিল আরেক প্রস্থ আনন্দপীঠ। আমার কখনও সুযোগ হয়নি বাসে চড়ার। পথে যেতে কখনও স্কুলের নামাঙ্কিত বাসগুলোর দেখা পেলে, কেন জানিনা খুব রোমাঞ্চ হত। একটি লাল সাদা রঙ করা গোল মতো গাড়ি চড়ে একটি ছেলেকে আসতে দেখতাম। সম্ভবত ও তখন একাই অমন ব্যক্তিগত গাড়ি চড়ে আসত। আমাদের চেয়ে ছোট। পরে জেনেছি, বিখ্যাত যাত্রাশিল্পী শান্তিগোপালের ছেলে। শান্তিগোপাল কয়েকবার আমাদের উৎসব প্রাঙ্গনে পালাও করেছিলেন। মিলন স্যার গোঁফ কেটে, কোন স্ত্রী চরিত্রে অভিনয় করে ছিলেন। উৎসব শেষে তাঁকে গোঁফ ছাড়া গ্রহণ করতে আমাদের বেশ মজা লাগত। বিরাট শোভাযাত্রায় আরেকটি মনে রাখার মত দৃশ্য ছিল, কবিদত্ত স্যারের ছবি তোলা। পুরো শোভাযাত্রাটির বিভিন্ন মুহূর্ত তাঁর ক্যামেরা বন্দী হয়ে থাকত। আর সে জন্য তিনি কখনও রাস্তার পাশে কোন গাছে চড়ছেন কখনওবা কারো বাড়ির ছাদে। শীর্ণকায় মানুষটির এই ছুটে ছুটে জায়গা বদল করাও আমাদের মনের খাতায় চির বন্দী হয়ে রয়েছে। এমন হাতে হাতে তখন ক্যামেরা ছিলনা, তার এই পরিশ্রম করে ছবি-তোলার ছবি, কেউ তুলে রাখিনি।

[প্রথম প্রকাশঃ খোলামকুচি ব্লগ, ২৭ জুলাই, ২০১৬, https://howladersourav.blogspot.com/2016/]

ছবির ঋণঃ রহড়া রামকৃষ্ণ মিশনের ফেসবুক পাতা https://www.facebook.com/rkmrahara/photos

এই গল্পটি পড়ে দেখতে পারেনঃ ঘুড়ি

Facebook Comments Box

আমি ইমেল-এ খবরাখবর পেতে আগ্রহী

This Post Has 4 Comments

  1. সৌরভ পাল

    সহস্র বিস্মৃতি রাশি প্রত্যহ যেতেছে ভাসি তারি দুচারিটি অশ্রুজল…. এই অশ্রুবিন্দুগুলিই কবে যেন মুক্তো হয়ে রয়ে যায় সারা জীবনের সঞ্চয়ে। অসামান্য স্মৃতিচারণ।

    1. Admin

      অনেক ধন্যবাদ

      1. TANMAY BANERJEE

        এমন সব মধুর স্মৃতিকথা বিস্মরণের অতীত।

      2. TANMAY BANERJEE

        এমন সব মধুর স্মৃতিকথা বিস্মরণের অতীত।

Comments are closed.