Yashodhara Roychowdhury

বইয়ের কথা: সাম্প্রতিকতম ইতিহাসের পদচিহ্ন

বইয়ের নাম – অনাহত
লেখক – সৌরভ হাওলাদার
প্রকাশক – অনার্য
প্রকাশকাল – ২০২২
বিনিময় – ৩১৫ টাকা
“We are not makers of history. We are made by history.”
– Martin Luther King, Jr.
সৌরভ হাওলাদারের নামের সঙ্গে বাংলার পাঠক অল্পবিস্তর পরিচিত। তাঁর নানা গল্প নানা জায়গায় চোখে পড়েছে আমাদের। এবারে একটি গোটা গ্রন্থ হাতে আসে। ‘অনাহত’। প্রকাশক ‘অনার্য’। এ গ্রন্থের বিষয়বস্তু ঠিক কী তা বলতে গেলে দুভাবে বলা যায়। এক, গল্পসংগ্রহ। দুই, ফিক্সআপ নভেল। আসলে বিদেশের রে ব্রাডবেরি আদি বহু লেখক, লিখেছেন ফিক্সআপ নভেল। উপন্যাসোপম গল্পসংগ্রহ। যেখানে একেকটি গল্প নিটোল হয়েও, একে অপরের গায়ে হেলান দিয়ে আছে। সৌরভ একটি সময়খণ্ডকে তুলে নিয়েছেন তাঁর গল্পের পটভূমি হিসেবে। সময়টা হল কোভিডকাল। ২০২০ সালের মার্চ মাসে যার সূচনা এক জাতীয় লকডাউন দিয়ে। তারপর প্রায় দুবছর ব্যাপী দুঃস্বপ্নোপম একটি সময়খণ্ড আমাদের দেখা চেনজানা পৃথিবীকে অনেকটাই পালটে দিল। (… আরও পড়তে ক্লিক করুন)

সৌরভের অনাহতের ব্লার্ব বলছে—
অদ্ভুত আঁধার নেমেছে পৃথিবীতে। মৃত্যুভয়ে কোণঠাসা মানুষ। দর্পণে তার ছায়া পড়ে, সময়ের দাগ রেখে যায়। সাহিত্য সেই দর্পণ, সেখানে স্থায়ী হয়ে থেকে যায় সমসাময়িকের প্রতিচ্ছবি। দু’হাজার কুড়ি থেকে দু’হাজার একুশের অতিমারীর এক মানবিক দলিল ‘অনাহত’।

প্রেক্ষিত তো জানা। কিন্তু এই প্রেক্ষিতে কী করলেন সৌরভ? তিনি এই বইতে রাখলেন ২৩ টি গল্প। প্রতিটি গল্পে ঘুরে ফিরে আসে হাতেগোণা কিছু চরিত্র। প্রতিটি চরিত্র আস্তে আস্তে চারিয়ে যায় আমাদের ত্বকের ভেতরে। চরিত্রগুলি ক্রমশ ‘আমরা’ হয়ে উঠি। একেকটি চরিত্রকে নিয়ে, একাধিক দম্পতিকে নিয়ে একাধিক গল্প বুনেছেন তিনি। আবার জুড়ি ভেঙে দিয়ে, একেকটি দম্পতির স্বামী বা স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে আরেকটি অন্য নারী বা পুরুষের। একটা তাসের ঘরের মতো অনুভব চারিয়ে যায় পাঠকের ভেতরে। তৈরি হয় গগন-তিয়াসা, সনৎ-মানসী, সোমনাথ-বীথি, এমন অনেক জুটি। আরও বড় বৃত্তে আসে নুরুল মইদুল, আসে বিল্টু-পল্টু, যেন একটা দীর্ঘ মিছিল, দড়ির প্রান্তে বাঁধা কালিপটকার মতো। সকলেই অসহায় ক্রীড়নক, এই বিপুল অতিমারীর প্রকাণ্ড চালচিত্রের ওপরে।

এখানেই সৌরভের সাফল্য। কেননা, যে পাঠক এই পর্বের ভেতর দিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁর স্মৃতিতে আজও তাজা কোভিড অতিমারী ও লকডাউনের স্মৃতি। কিন্তু একইসঙ্গে এই জীবন-বদলে-দেওয়া অপ্রিয় প্রসঙ্গটি ভোলার জন্যও উন্মুখ হয়ে আছেন পাঠক, কাজেই সে প্রসঙ্গ পুনঃ পুনঃ তোলাটা খুবই বেদনাদায়ক। কবি তো সেই কবেই বলে গেছে, কে আর হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে? উপরন্তু সমস্ত পাঠকই আমরা ধরে নেব, কোনও না কোনও আত্মীয় বা বন্ধুর মৃত্যুর যন্ত্রণা পেয়েছেন ওই সময়পর্বে। অথবা ব্যথিতচিত্তে লক্ষ করেছেন পরিযায়ী শ্রমিকের বেদনাদায়ক দেশান্তরী হওয়া, মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে অতিক্রম। লক্ষ করেছেন একা মানুষের লড়াই, দরিদ্র মানুষের কষ্ট, উচ্চস্তরের চাকুরের চাকরি হারানোর সাংঘাতিক মানসিক আঘাত। কিন্তু যে কোনও নঞর্থক অভিজ্ঞতাকেই আমরা যতদূর সম্ভব দূরে নিক্ষেপ করে আবার নতুন আলো ও আশার দিকে চলতে চাই, এটাই জীবনের ধর্ম।

কিন্তু ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেন পণ্ডিতেরা আর সাহিত্যিকেরা।

সাহিত্য তো জীবনের সহিত থাকার অঙ্গীকার। কাজেই জীবনকে লিখে চলা ছাড়া কোনও কাজ থাকেই না তো আমাদের। আর পড়তে পড়তে আমরাও যেন এক ঘোরের মধ্যে প্রবিষ্ট হই।

তাই সৌরভ সৃষ্টি করেন গগনকে, যে একটি প্রাইভেট-সেক্টর কর্মী। তার স্ত্রী তিয়াসা। তিয়াসার সঙ্গে ভাব ভালোবাসা গড়ে উঠেছে সোমনাথ নামে এক ডাক্তারের। হাসপাতালের ডাক্তার। ফ্রন্টলাইন ওয়ার্কার। তার চোখ দিয়ে এসে পড়ে বাকি চিকিৎসাক্ষেত্রের কর্মীরা। সোমনাথের স্ত্রী বীথি আসে।

“হাসপাতালগুলো এখন সত্যিই যেন যুদ্ধক্ষেত্র। মুখ, মাথা, গা ঢাকা দিয়ে লোকজন চলছে। চারদিকে সব বন্ধ, শুধু এখানেই কোনও বিরাম নেই। আর্তনাদ করে অ্যাম্বুলেন্সগুলো ঢুকছে বেরোচ্ছে। সৎকার সমিতির মৃতদেহ বহন করার গাড়িও আছে। কাচের ভেতর দিয়ে পুরো পলিথিনের মোড়কে মোড়া দেহ নিয়ে দুজন পার্সোনাল প্রোটেকটিভ ইকুপমেন্টের জামা, গ্লাভস, টুপি, জুতো পরে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। নিকটজনের কান্নার রোল ওঠে, শেষ যাত্রায় শরিক হওয়ার অনুমতিও মেলে না। সব মিলিয়ে অস্বাভাবিক উদ্বেগ আর আর হতাশার আবহ, পুরো পরিকাঠামোতে মজুত হয়ে আছে।”

কত চেনা এই কথাগুলো, তাই না? বারংবার সেই ঘুরে ঘুরে আসা গানের পংক্তির মতো এই ধুয়ো এসেছে অনাহততে। জীবনের দিকে ফেরা, পাশাপাশি মৃত্যুর করাল ধ্বনি।

“হাসপাতালের ভেতর ঢুকলে, রাত না দিন বোঝা যায় না। সব সময় নিয়নের বাতি জ্বলছে, আর শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের বাতাস, সঙ্গে নানা ওষুধ মিলে একটা ঠান্ডা ঘ্রাণ কেমন আচ্ছন্ন করে রাখে। ডাক্তার বলে, “ওনার সি-আর-পি এখনো কমেনি। আমরা চেষ্টা করছি। আর যেহেতু ওই ওয়ার্ডে কোভিড পেশেন্ট পাওয়া গিয়েছিলো, তাই কটাদিন আপনাদের সাথে রোগীর দেখা করানো যাবে না।”

এই জগৎ নিরবচ্ছিন্ন থাকে না, গল্প থেকে গল্পে ক্রমশ বিস্তীর্ণতর অন্য অনেক নিরুপায়তা, আমাদের চেনা আরও নতুন কদর্যতা, নতুন নিস্তারহীনতা, নতুন ট্রমা ঢুকে পড়ে। সরকারি ডাক্তার সোমনাথের উলটো মেরুতে থাকা প্রাইভেট সেক্টরের গগনের অভিজ্ঞতা এরকম হয়, এও আমাদের কতটাই না চেনা ট্রমা!

“এখন ওয়ার্ক-ফ্রম-হোম-এ নিস্তার নেই। গগনের আপিস থেকে লিখিত নির্দেশিকা জারি হয়েছে, তিনটে রিং বাজার মধ্যে ফোন ধরতে হবে, যেকোনও ইমেল আধ ঘণ্টার মধ্যে উত্তর দিতে হবে, কথা বলার সময় পারিপার্শ্বিক কোনো আওয়াজ যেন না আসে ইত্যাদি অনেক রকম। তাই সব সময় তটস্থ থাকতে হয়। সবাই বাড়ি থেকে কাজ করছে। তাই কাউকে দেখা যাচ্ছে না, যে তারা আসলে ঠিক কী করছে? অনেকেই সেজন্য সারাক্ষণ ফোন, ইমেল আর কনফারেন্স কল-এ ব্যস্ত হয়ে থাকছে। খানিকটা লোকজনকে বোঝানো, যে তারা কাজ করছে। যদিও সেই সব কাজের ফলাফল শূন্য।”

শূন্য! এই ‘শূন্য’ শব্দটি পাঠককে তাড়া করে। তাঁর নিজ অভিজ্ঞতায় বারবার এই শূন্যের কথা এসেছে। এসেই গেছে। নানাভাবে এক শূন্যতাবোধ। দুর্গাপুজোর মণ্ডপ, কালিপুজোর বাজি, তার পেছনেও আছে কোভিডের পদধ্বনি, ভয়-ভীতি, বাইরে বেরুতে না পারা।

আর অতিমারী ও তার প্রকোপের বিরুদ্ধে গোটা সমাজের লড়াই, সিস্টেমের লড়াই, লকডাউনের ভ্রান্তিময় পরিস্থিতি, তার তলায় এই প্রচণ্ড তাড়িত পশুর মতো অবস্থায় মানুষের সম্পর্কগুলো কী রূপ ধারণ করে? ভয়াবহ পরিণতি হয় প্রতিটি সুকুমার প্রবৃত্তিরও। মানুষ ক্রমশ প্রাইভেসি হারায়, স্বামী স্ত্রীর মধ্যে বিশ্বাস চলে যায়। আদিত্য-ধৃতির সম্পর্কের ভেঙে যাওয়া স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আবার তিয়াস আর গগনের আপাতসুন্দর সম্পর্কেও বিবাহ-বহির্ভূত চোরকাঁটা টের পাওয়া যায়।

“গগন সনতের দিকে তাকিয়ে আলগা একটা হাসি দেয়। বোঝে এ সবই নদীর একূল আর ওকূলের কথা। গগন এই লকডাউনের মধ্যে কয়েকবার বেশ অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়ে গিয়েছে। সারাক্ষণ বাড়িতে থাকায় দুজনের মধ্যে কোনও নিজস্ব জায়গা নেই। গগন সহজেই বুঝতে পেরেছে, তিয়াসা অন্য বিশেষ কারও সাথে কথা বলে। হঠাৎ করে গগন ঘরে আসায়, সেই কথায় ছেদ টানতে হয়। আর সেই ব্যক্তি, অন্তরঙ্গ কেউ। কথার টুকরো চোখে গালে অভিব্যক্তির সাথে লেগে থাকে। তিয়াসা বুঝতেও পারে না। তার মুখ, তার মনের আয়না হয়ে থাকে। তবে গগন কখনো আগ বাড়িয়ে, কার সাথে কথা বলছে.জানতে চায়নি । তিয়াসা নিজে থেকে কোনোদিন কিছু বলেনি।”

এই বইয়ের অসামান্য এক খণ্ড, একটি গল্প ‘অনিকেত’। একটি গাছতলায় আশ্রয় নেওয়া একাকী অসুস্থ মানুষ। হঠাৎ একদিন তাকে পাড়ায় দেখতে পায় সবাই। তাকে খাবার দিতে চায় মানবিকতা বোধ থেকে। কিন্তু আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন অনিকেত মানুষটি। সরকারের সাহায্য চাওয়া হয়। কিন্তু কিষনচন্দের বিখ্যাত ‘জামুন কা পেড়’ গল্পের মতই এই সাহায্যটা আর এসে পৌঁছতে পারে না। তার আগেই মানুষটি মারা যান। তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে কী ঘটে?

“সনৎকে নিয়ে খুব তাড়াতাড়ি দুজনে বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছায়। এসে দেখে দমকলের লোকজন বড় হোস দিয়ে পুরো জায়গাটার শুদ্ধিকরণ করছে। গতকাল, পরের পর ফোন করে প্রশাসনের কাউকে পায়নি, আর আজ সব বিভাগের লোক কাজ করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সনৎ ছেলেমানুষের মতো গগনকে ধরে কাঁদতে থাকে। গগন বুঝতে পারে না কীভাবে সান্ত্বনা দেবে?

চারদিক জলে ভরে গেছে। রাসায়নিক-মিশ্রিত জল বাসস্ট্যান্ড ছাপিয়ে রাস্তার ধুলো কাদা করে দিচ্ছে, যা খানিক পর আবার শুকিয়ে যাবে। মানুষটার সম্পূর্ণ উপস্থিতি এই পৃথিবীর মাটি থেকে মুছে যাচ্ছে। কোথাকার মানুষ, কীভাবে এল কেউ জানবে না। ওর বাড়ির লোক, আপনার জন কেউ তো থাকবে? গগন বা সনৎ কিছুই বুঝতে পারে না। বিশ্বব্যাপী মড়কের পরিসংখ্যানের শুধু একটা সংখ্যামাত্র হয়ে, লোকটি নিজের উপস্থিতি রেখে গেল।”

এইভাবেই গল্পের পর গল্প এসেছে। একেকটি কথোপকথন খচ করে বাস্তবকে উলঙ্গ করেছে। আমাদের বুকের মধ্যে বিঁধেছে। যেমন এই ছুটকো ডায়ালগ, দেখিয়ে দেয় সৌরভের ব্যাপ্তি ও ক্ষমতাকে।

“রাম ভরসায় সব চলছে। সামনের সপ্তাহে মদের দোকান খুলে যাচ্ছে।”

“সে কী? কেন?”

“বোঝ না? সব কিছু বন্ধ। সরকারের রোজগার তলানিতে। না খেতে পেলেও লোকে মদ কিনবেই। আর পথ কোথায়?”

“আর জরুরি পরিষেবা?”

“নেশা জরুরি পরিষেবা নয়, তোমায় কে বলল?”

এভাবেই গোটা পরিমণ্ডলের মধ্যে আমাদের টেনে নেয় ২৩টি গল্প। সরকারি চাকুরের বয়ানে যখন বলা হয়, সরকার সব অংক প্রকাশ করে না, আমরা একেবারে নীচের তলায় কাজ করি। আসল অবস্থা আমাদের কাছ থেকে জানতে পারবে। তখন বোঝা যায় কত বড় সামাজিক দায় পালন করেছে এই বইটি।

কতগুলো পরতে সমাজকে দেখিয়েছেন সৌরভ। প্রায় সিনেমাটিক ভঙ্গিতে সোমনাথের দুঃস্বপ্নের ভেতর সে হোঁচট খায় ট্রেন লাইনে শুয়ে পড়া পরিযায়ী শ্রমিকদের সঙ্গে… যারা মারা গিয়েছিল চলন্ত ট্রেনের ধাক্কায়, চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল রক্তমাখা রুটি।

দর্শনের পাঠ, বৌদ্ধ দর্শনের ক্ষণভঙ্গবাদিতা, অথবা অনাহত নাদের কথা অনায়াসে লিখেছেন সৌরভ, বুনে দিয়েছেন তাঁর চরিত্রদের সঙ্গে। সনৎ চরিত্রটি যখন অসুখ আর নিরাশার কথা ফেলে দর্শনের কথা বলেন, তখন আর তা থাকে না নিছক এক বুলি আওড়ানো, হয়ে ওঠে জীবন দর্শন, লাইফলাইন বা লাইফ বোট।

সুন্দর ছাপা, চমৎকার টিন্টেড পুরু কাগজে তৈরি সুগঠিত বইটি একটা দলিল হয়ে থেকে গেল। পাঠক একে তুলে নিন, এটাই কামনা। সাম্প্রতিকতম ইতিহাসকে লেখার ভেতরে রিয়েল টাইমে তুলে আনার স্পর্ধা ও সাহস যাঁরা করেন তাঁদের মান্য লেখক বলতেই হয়।

[প্রথম প্রকাশঃ বাংলালাইভ ডট কম, ২৫শে ডিসেম্বর, ২০২২ https://banglalive.com/sourav-haoladar-book-review/]

যশোধরা রায়চৌধুরি, লেখক

লেখাটা পড়ে একটা ঝাঁকুনি খেলাম। ব্রিলিয়ান্ট

সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায়, বিপণন বিশেষজ্ঞ
সব্যসাচী
Achintya

খুব ভালো লাগছিল পড়তে। অনেকদিন বাদে পড়ছিলাম। আজকাল আর পড়তে ভালো লাগে না। কিন্তু তোমার লেখাটার মধ্যে একটা নেশা ছিল। হঠাৎ খেয়াল করলাম যে শেষ হয়ে গেলো।
আরো জানতে চাই যে সলতে, বিধান আর অধীরের কথা।

অচিন্ত্য কর্মকার, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ

আপনার লেখা বড্ড হৃদয় ছুঁয়ে যায়…

মণিজিঞ্জির সান্যাল
লেখক

Manijinjjir
পবিত্র চক্রবর্তী

পড়লাম। আপনার অন্যান্য রচনার মতো খুবই ভালো লাগলো। মনে করে এই আনন্দের ভাগিদার করার জন্য আপনাকে অজস্র ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।

পবিত্র চক্রবর্তী, প্রকৌশলী

মোহের টানে কিসের পানে কেই বা জানে!! 

ভালো লাগলো।

সৌরভ পাল, অধ্যাপক
সৌরভ পাল
সন্দীপন

বেশ ভালো। শেষটা খুব প্রতীকী।

সন্দীপন বিশ্বাস, সাংবাদিক

ননিলিয়ন

গল্পকার শ্রী সৌরভ হাওলাদারের তৃতীয় গল্প সংকলন ‘ননিলিয়ন’ প্রকাশিত হয়েছিল ২০২০ সালে বাংলাদেশের অমর একুশে বইমেলায়। বইটি পড়ার জন্য আগ্রহ ছিল খুব। কারণ দুটো, প্রথমতঃ আগের দুটি বই পড়ার অভিজ্ঞতায় বুঝেছিলাম সৌরভের গল্প বলার মুন্সিয়ানা ওঁর পূর্বজ অনেক প্রতিষ্ঠিত গল্পকারের থেকে ঈর্ষণীয় ভাবে এগিয়ে এবং দ্বিতীয়ত: সৌরভের বিচরণ আমার দীর্ঘদিনের চেনা গণ্ডীর থেকে অনেক বেশী ব্যাপ্ত পরিসরে। (… আরও পড়তে ক্লিক করুন)
Details

এই সংকলনে মোট ষোলটি গল্প রয়েছে।তাতে মানুষের মন ও মানবিক সম্পর্কের নানা রঙের সমাহার।নানান পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে বিভিন্ন মানুষের মধ্যে সম্পর্কের বিন্যাস নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে সৌরভ দেখিয়ে চলেছেন বলে তাঁর বইগুলির আকর্ষণ বজায় থাকে এবং ক্রমশঃ বাড়ে।যে কোন লেখকই তাঁর অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির আলোয় বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে পাঠকের কাছে নানা রকমের বার্তা নিয়ে আসেন তাঁদের সচেতন করার জন্য। একাজে তাঁর দায় থাকে একমাত্র পাঠকের প্রতি।সেইভাবে সৌরভের এই সংকলনে নানা রকমের বার্তা আছে যেগুলো নিয়ে একটু আলোচনা করার ইচ্ছে থেকে আমার এই লেখা।

এই সংকলনের প্রথম এবং নামগল্পটি পড়ার পরে আমার আনন্দবাজার পত্রিকার একটি আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপনের কথা মনে পড়ে গেল।’ আনন্দবাজার পড়তে হয়,নাহলে পিছিয়ে পড়তে হয়। ‘ এই গল্পটিতে আমাদের চেনা এবং ক্রমশঃ প্রিয় হয়ে ওঠা একটি জগতের কথা বলা হয়েছে।কিন্তু তার মধ্যে লুকিয়ে থাকা ভীষণ ভাবে অচেনা এক ভয়ঙ্কর ফাঁদের কথা সৌরভ আমাদের জানাতে চেয়েছেন যেটাতে পা দিলে কোন ব্যক্তি বা পরিবারের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে যেতে পারে।নিত্যদিন ফেসবুক বা ইউটিউবের পর্দায় নিরন্তর আমাদের ব্যক্তিগত পছন্দের বিষয়ে নানাধরনের বার্তা যুগিয়ে যাচ্ছে যে ম্যাজিক সেটা নিয়ে আমরা কজন মাথা ঘামাই? সেটা হল, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। যার তথ্য যাচাই,বাছাই এবং বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা আমাদের সাধারণ মানুষের কল্পনার বাইরে।এই যাচাই ও বিশ্লেষণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রতি মুহূর্তে যাচাই হয়ে যাচ্ছে একজন ব্যক্তি মানুষের দৈনন্দিন জীবন যাপনের ধারা,পছন্দ অপছন্দ এমনকি গোপন ইচ্ছেগুলির কথাও।সেগুলি কাজে লাগিয়ে বানিজ্য জগতের মানুষজন যে কোন মানুষকে কিভাবে প্রলুব্ধ করে নিজেদের কব্জায় নিয়ে তার জীবনকে তছনছ করে দিতে পারে,সরল ভাষায় এবং বিস্তারিত ভাবে সৌরভ এই গল্পটিতে বলে তাঁর একটা সামাজিক দায়িত্ব পালন করেছেন।

কর্মসূত্রে কম্পিউটার এবং কর্পোরেট জগতের মানুষ বলে সৌরভ সেই জগতের অন্ধকার দিক গুলি কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছেন। কর্পোরেট জগতের ঈর্ষা কতটা নিষ্ঠুর হয়ে একজন সফল মানুষকে কিভাবে ধরাশায়ী করে দিতে পারে,তার একটি গল্প তাঁর প্রথম গল্প সংকলনে পেয়েছিলাম।এই সংকলনে ও সেরকম আর একটি গল্প পেলাম।এই গল্পটিতে বাড়তি যেটা পেলাম সেটা হল,সেই সফল মানুষটি যদি নারী হন এবং বাড়তি গুরুত্ব পাবার জন্য যদি তিনি তাঁর শরীরকে কোনভাবে ব্যবহার করেন তাহলে তার পরিণতি আরও মর্মান্তিক হয়।গল্পটিতে সৌরভ অন্য একটি গল্পের আভাস দিয়ে এটাও জানাতে চেয়েছেন যে এই পরিণতির ব্যাপারে নারীদের কোন স্তরভেদ নেই ( ষড়রিপু )।

সাফল্য মানুষের জীবনকে যত স্বচ্ছন্দ করে,তার জীবনে ব্যবহারিক লেনদেনের সম্পর্ক মুক্ত সামাজিক বা অন্তরঙ্গ সম্পর্কের গণ্ডিটি ক্রমশঃ ছোট হতে হতে তাকে নিঃসঙ্গতার দিকে ঠেলে দেয়।প্রযুক্তির কল্যাণে অন্য মানুষজনের উপর সরাসরি নির্ভরতা মানুষের কমে যাচ্ছে।পাওয়া যাচ্ছে মানবিক সম্পর্কহীন পরিষেবা প্রায় সব ব্যাপারেই।আধুনিক জীবনে এর প্রতিক্রিয়ায় জটিল মানসিক রোগের প্রকোপ বেড়ে চলেছে।সমাজের সব স্তরে অবাধ বিচরণের সুবাদে এই সব সমস্যার সমাধানের জন্য সৌরভ কিছু পথনির্দেশ দেখাবার চেষ্টা করেছেন।তিনি তাঁর গল্পের মাধ্যমে বারে বারে দেখিয়েছেন যে বহুতল বাড়ীর সফল মানুষদের সাথে মাটির কাছাকাছি থাকা মানুষগুলোর অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক আছে।তারা একে অপরের পরিপূরক।তাই একটু সহমর্মিতার চোখে সেইসব মানুষগুলোর সাথে প্রতিদিনের একটু আধটু মানসিক লেনদেন উভয় গোষ্ঠীর মানুষকেই অনেকটা স্বস্তি দিতে পারে।জরুরী প্রয়োজনের সময় সেই মানসিক সম্পর্কগুলো জটিল সমস্যার সমাধানে অনেকটা সাহায্য করতে পারে।

সেই রকম একটি মজাদার গল্পে আমরা একজন সেয়ানা বাউন্ডুলে মানুষের পরিচয় পাই যে ক্রিয়া – প্রতিক্রিয়ার সমীকরণ মেনে জীবনে ভারসাম্য বজায় রেখে চলে।তার চার পাশের মানুষরা তাকে মেনে ও মানিয়ে নিয়ে জীবনের চলার পথকে যেভাবে সহজ করে নেয় তাতে একটি সুন্দর সমন্বয়ের ছবি ফুটে ওঠে ( ম্যাথমেটিক্স )।

একটি গল্পে একজন মানুষ একটি ঘটনার মধ্য দিয়ে এক উপলব্ধি লাভ করে।গ্রামের অশিক্ষিত সাধারণ গরীব মানুষরাও এখন বুঝে গেছে যে কোনও কিছু সাহায্য পেতে গেলে বিনিময়ে তাদেরও কিছু ছাড়তে হয় ( অর্শী )।

ব্যবহারিক জীবনের সমস্ত রকমের হিসেব নিকেশ ছাপিয়ে যখন মানুষের মৌলিক আবেগ মনের উপর কর্তৃত্ব করে তখন গল্পের পাঠককে একটা মধুরতম অনুভূতির সামনাসামনি করিয়ে দিতে পারে,এমন একটি গল্প পাঠের অভিজ্ঞতা হল এই সংকলনে ( ও আমার দেশের মাটি )।

এই সংকলনে প্রেম বিষয়ক গল্প আছে চারটি।সব গল্পগুলিতেই এই প্রেম বেদনার রসে জারিত। বিড়ম্বিত দাম্পত্য জীবনের দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বাদের গল্পের সমস্যা একটাই।স্বামী বা স্ত্রীর যে কোন একজন মানসিক রোগের শিকার।তারা নিজের মনগড়া জগতের বাসিন্দা বলে বাইরের জগতের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারেনা।প্রথম গল্পটিতে স্বামী ডাক্তারের পরামর্শ মত আপ্রাণ চেষ্টা করে চলে স্ত্রীকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে।কিন্তু যখন তার মনে একটা আশা জাগে যে হয়তো খুব তাড়াতাড়ি তার স্ত্রী সুস্থ হয়ে উঠবে,ঠিক তখনই বিপর্যয় ঘটে তার জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ে।দীর্ঘদিনের সহকর্মী বন্ধুর কাছে তার এই আন্তরিক প্রচেষ্টা তাকে এক নতুন রূপে পরিচিত করে (অচেনা )।

দ্বিতীয় গল্পে জীবনে প্রতিষ্ঠিত এক নারী তার স্বামীর অসংলগ্ন আচরণের জন্য ঘরে বাইরে বিড়ম্বিত হতে হতে যখন এক অসহনীয় অবস্থায় পৌঁছয় তখন হঠাৎ আবিষ্কার করে চারিদিক থেকে কোণঠাসা এই অসহায় মানুষটির জন্য তার মনের গভীরে কিছু ভালবাসা তখনও বেঁচে আছে।মানুষটির প্রতি এক অদ্ভুত মমত্ববোধ তার মনকে আচ্ছন্ন করে ( দ্বৈতসত্তা )।শত প্রতিকূলতার পরেও প্রেম যদি কারো মনে জেগে উঠতে পারে তবে সেই প্রেম মহার্ঘ্য হয়ে ওঠে।

একজন পুরুষের কৌতুহলী চোখ তার দৃষ্টি সীমানার মধ্যে থাকা একটি নারীর প্রতিদিনের জীবন যাপন পর্যবেক্ষণ করে।সে অনুভব করে,নারীটির জীবনে বেশ শূন্যতা বোধ আছে।কোনভাবে সে ওই নারীর ফোন নাম্বার জোগাড় করে তার নিভৃত জীবনে হানা দেয়।কৌতুহলী নারীটি ও তার ডাকে সাড়া দেয়।দুজনেই দুজনের কাছে নিজেদের প্রকৃত পরিচয় গোপন করে তাদের মধ্যে কথোপকথন চালিয়ে যেতে থাকে।পুরুষটির কথার জাদুতে মোহিত হয়ে যাওয়া নারীটি ব্যস্ত হয়ে ওঠে তাকে কাছে পাবার জন্য।কিন্তু পুরুষটি তার অকিঞ্চিৎকর জীবনের সাথে নারীটিকে যুক্ত করে নারীটির জীবনের ভারসাম্য নষ্ট করতে চায়না।তাই নিজেকে আড়ালে রেখেই নারীটিকে সে তার জীবনের সেরা উপহারটি পাঠিয়ে দেয় সংলাপের মাধ্যমে।নারীটির অবরুদ্ধ অন্ধকার মনের ঘরে সে একটি জানলা তৈরী করে দেয় যেখান দিয়ে নারীটি একটু বাইরের আলো বাতাস পেতে পারে ( আবরণ )।

সংলাপ নির্ভর এই প্রেমের গল্পটি আমার অসম্ভব ভাল লেগেছে।

যদিও এই সংকলনের প্রায় সবকটি গল্পই অল্পবিস্তর মন আলোড়িত করা,তার মধ্যে কয়েকটি গল্পের কথাই বললাম।ষোলটি গল্পের এই সংকলনে যদি অন্তত বারো তেরো টি গল্পও পাঠকের কাছে রসোত্তীর্ণ মনে হয় তাহলে লেখকের সেই সাফল্য কম প্রশংসনীয় নয়।আশা করব,সৌরভের আগামী দিনের গল্পগুলি আরও সাফল্য নিয়ে পাঠকের দরবারে আসবে।

চন্দন সেনগুপ্ত, সমালোচক
চন্দন সেনগুপ্ত

আমি ইমেল-এ খবরাখবর পেতে আগ্রহী