হঠাৎই আলো ছড়িয়ে ফাল্গুন আসে। সকালের বাতাসে সামান্য শীতভাব আর দখিণা চিঠি খবর জানায় মনের গহীনে; যেন এক গভীর ষড়যন্ত্র! ঘুম ভেঙে যায় এমনি এমনি। দরজা ঠেলে বাইরে আসে সোহম।
সামনে এ কে? বাসন্তী রঙের শাড়িতে দাঁড়িয়ে, আলোর গুঁড়ো চুলের ওপর, গালের ওপর, লিখে রেখেছে নতুন কথা। সোহম শব্দ করতে সময় নেয়, “তোকে তো চিনতেই পারিনি।”
হাতের মুঠোয় আবির নিয়ে পিউ কিন্তু সময় নষ্ট করে না।
সোহমের দাড়িতে চুলে, রোদের রঙ হলুদ। সোহম চমকে ওঠে, “করিস কী? এখনও হাত মুখ ধোয়া হয়নি।”
পিউ যেমন চকিতে এসেছিল, তেমনি ছুটে বেরয়। যেতে যেতে বলে যায় “হোলি হ্যায়।”
গুঁড়ো আবির মাথা থেকে দাড়ি থেকে ঝুরঝুরিয়ে নামতে থাকে। মা দেখে হেসে ফেলে, “পিউ এসেছিল?”
সোহম বলে, “আমি তো চিনতেই পারিনি। সেদিনও তো ফ্রক পরে ঘুরতো।”
“সেদিন কি আছে? তুই এবার কত বছর পর এলি, খেয়াল আছে?”
A shari can change the feeling abruptly. It is not only a piece of cloth but feelings and experience.
ক্যাম্পাস থেকে চাকরি পেয়ে সোহম প্রবাসী। কাজের তাড়ায়, এদেশ ওদেশ করে মায়ের কাছে ফিরতে প্রায় আড়াই বছর ঘুরে গেল।
এর মধ্যে গুটি কেটে শুঁয়োপোকা প্রজাপতি হয়েছে, সোহমের জানার কথা নয়। শাড়ি পরেই মেয়েটা যেন নারী হয়ে উঠেছে। এ কথা মা-কে বলতে পারেনা। তবু মা যেন ঠিক বুঝে যায়, “পিউকে পছন্দ?”
সোহম বিপদে পড়ে। এতদিন বাড়ির কথা কান দেয়নি। চোখের সামনে এলিজিবল ব্যাচেলর দেখে আত্মীয়স্বজন যেন হামলে পড়ে। প্রত্যুত্তরে সোহমের একই কথা, “নিজের রোজগারে, আর কটা দিন স্বাধীন থাকি?”
একটা বাসন্তী রঙের শাড়ি যেন আত্মবিশ্বাসের ভিত টলিয়ে দিল। মায়ের কথার ওপর কিছু বলতে পারে না।
সুলেখাও ছেলেকে পড়তে পারেন অনায়াসে। পিউকে ছোট থেকে দেখছেন। এ বাড়িতে ওর আসা যাওয়া অবাধ। এই দুটিতে জুটি বাঁধলে, তিনি শান্তিতে মরতে পারেন।
সুলেখার ভেতরে ভেতরে ক্ষয় হচ্ছে বহুদিন। ওর বাবা চলে যাওয়ার পর অনেকটা পথ পার হয়ে গেল। এখন ছেলে কর্মসূত্রে বিদেশে, তেমন ভাবে কখনও সোহম নিজের কথা বলার সুযোগ পায়নি। সুলেখাও ছেলেকে জোর করেননি, নতুন জীবনে অনাবশ্যক বিব্রত হবে। আজ পিউ-র সঙ্গে একসাথে দেখে বোধহয় একটা সুপ্ত ইচ্ছে জেগে উঠল।
সোহম কথা ঘোরানোর চেষ্টা করে। “আজকের দিনে তুমিও একটা বাসন্তী রঙ পরতে পারতে। সেই এক ধূসর বা সাদা!”
সুলেখা হাসেন, “মায়ের রঙ, তার সন্তানের চোখে। তুই বড় হয়েছিস, নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছিস। সেইই আমার বাসন্তী।”
সোহম বা পিউ কারও আপত্তি ছিল না। পরের বৈশাখেই সাতপাক সম্পূর্ণ করে পিউকে নিয়ে নিজের কর্মস্থলে ফিরে যায় সোহম। সুলেখার একাকীত্বে ছেদ পড়ে না। ওর ফাঁকা ঘর ফাঁকাই থেকে যায়। নিয়ম করে ভিডিও কল-এ সে ফাঁক পূরণ হয় না।
পিউর কাছে নতুন শহর। আদব কায়দা, পোশাক আশাক, ভাষা সবই আলাদা। একটু একটু করে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করে। উইকেন্ড-এ সোহম নিয়ে যায়, কাছাকাছি বেড়ানোর জায়গা, শপিং মল বা অন্য কোন প্রবাসী বাঙালি বন্ধুর বাড়ি।
আবার করে বাংলা বলতে পেরে উজ্জ্বল হয় পিউ। যত্ন করে সাজে। সুলেখার দেওয়া একটা শাড়ি পরে। সোহম চমকে ওঠে, “এ শাড়ি, তুমি কোথায় পেলে?”
পিউ-র রহস্যময় হাসি ভিজিয়ে দেয়, “যার শাড়ি, সেই-ই দিয়েছে।”
এলোমেলো সোহম। বাবা বেঁচে থাকতে, সুলেখা এই শাড়ি পরতো।
নিমন্ত্রণ রক্ষায় দেরী হয়ে যাচ্ছে, সোহম তখন আর কিছু বলে না। ফিরে এসে পিউ-কে দুহাতে ভরে শূন্যে তুলে ধরে। সোহমের নাকে কস্তুরী শাড়ির সৌরভ। ওকে নিয়ে যায় বয়ঃসন্ধির দিনগুলোতে। সোহমকে ঘিরে মা বাবার যৌথ জীবন। যেন কোন ভিন্ন জন্মের রেশ, বহুদূর থেকে শাড়ির প্রতিটি সুতোয় মুড়ে চলে এসেছে সময় সরণির এই প্রান্তে।
পিউ ছটফট করতে করতে শান্ত হয়ে আসে। ধীরে ধীরে উন্মোচন হয় জীবনের দাগ, ভালবাসার পেলব ঢাকনা।
পিউ-র আঙুলগুলো সোহমের চুলে বিলি কাটে। অবাক হয়ে লক্ষ্য করে সোহমের দুচোখ জলে ভরে উঠেছে। শাড়িতে মগ্ন সোহম ওর মা-কে খুঁজতে থাকে।
A shari can change the feeling abruptly. It is not only a piece of cloth but feelings and experience.