উইঙসের ওপারে

Sunrise
Sunrise

উইঙসের ওপারে Other side of the wings.

ঠিক কতটা পেলে পাওয়া হয়? প্রশ্নটা সহজ। উত্তর খোঁজাটা একলার হয়না। মানুষের ভেতর বাহির ঘিরে রাখে আরও অনেক কিছু। সম্পর্কের বীজ, মায়া মমতার ছাল বাকল। সময়ের ডালপালায় নিজেকে ঢেকে রাখে। এতগুলো ঝুরি নেমেছে চারিদিক দিয়ে, তার মধ্যে ঠিক কোনটা আমার কান্ড, সেই অবয়বটি হারিয়ে যায়। কতকটা, “পথ ভাবে ‘আমি দেব’, রথ ভাবে ‘আমি’, মূর্তি ভাবে ‘আমি দেব’” অবস্থা। নিজের নানারূপ দেখে আমরা নিজেরাই অস্থির। অথচ এই অস্তিত্বর সঙ্কট থেকে উদ্ধার করবে কে? গেরুয়া বসনের সন্ন্যাসী? যিনি এই ছাল বাকলের পর্দা এড়িয়ে একক সত্যের পথে চলেছেন। নাকি গর্ভগৃহে অধিষ্ঠান রত কোন দেবতার মন্ত্রপূতঃ ঔজ্জ্বল্য? অথবা অতিদূর কষ্ট সহ্যকারী কোন দূর্গম পথ, যা পার হবার পর যুধিষ্ঠিরের মত বলতে ইচ্ছা করে, আমি এসেছি। সাথে চিরসাথী পোষ্যটি। কিন্তু পোষ্যর সাথে নিজের জীবনের আয়ু এক নয়, তাই তাকে ‘চিরসখা ছেড়না’ বলে জড়ালেও প্রাকৃতিক নিয়মেই সে থাকবে না। অতয়েব সারবত্তা হল একলা এসেছি একলা যাবো, মাঝের এই ভেজাল যত বাড়বে, তত একলা মানুষটি হারিয়ে যাবে।

মেলার মাঝে যেমনটা হয়

একলা একলা হারিয়ে যাওয়া। আসেপাশে এদিক ওদিক, এমনকি উপর নিচেও মানুষ থাকতে পারে। উপর নিচে থাকে না? নাগরদোলা ছাড়া মেলা হয়? তবে উপর নিচও হল। আর সব অচেনা মানুষ। অচেনা অর্থ, আগে দেখিনি। কথা কইনি। তবু তারা গা ঘেঁষে চলে যায়, আলগোছে কথাও কয়। জীবনের মতো, ভীড় রেলগাড়িতে কতশত মানুষের সাথে অন্তরঙ্গ গা ঘষাঘষি হল, তার কি কিছু রইল? না রাখা যায়। এ জগৎ তেমনটাই। তোমার আমার সুতোর বাঁধন জুড়তেও সময় লাগনা, ছিঁড়তেও না। এটুকুর জন্য এত মারপিট আর দাঙ্গা হাঙ্গামা করার কোন প্রয়োজন নেই। তাহলে কি সকলে দূরে দূরে থাকবে? এমনটাও হবার নয়। দূরে আছি মনে রেখে, কাছে থাকতে হবে। কি আব্দার! মায়ার বাঁধন কি একেই বলে? মহাত্মারা বলতে পারেন। আমি খুব সাধারন মাপের মঞ্চশিল্পী। না আছে ওজন, না আছে ছটা। যবনিকা না পড়া পর্যন্ত সহশিল্পীর সাথে সম্পর্ক, নাট্যকার, নির্দেশক যেমন বলে দিয়েছেন, তেমন। সে বাপ ছেলে, চোর পুলিশ, রাজা উজির যা কিছু হতে পারে। আবার উইঙস দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে অন্য ভাষা অন্য রূপ অন্য সম্পর্ক। তা জগৎএর উইঙস থেকে বেরিয়ে গেলে ঠিক কি হয়, সেটা জানিনা বলেই এত গোল। তা, থাকল না হয়, একটু রহস্য। চেনা স্টেশন পার হয়ে কোন অচেনা স্টেশনে গিয়ে নামব, সেটা সেই সময়ের জন্য তোলা থাকল। আবার কেউ কেউ বলেন, এই জগতে ঢোকা বেরনোর সময়গুলোতে স্মৃতি লোপ পায়, যন্ত্রে না কি এমনই প্রোগ্রাম করা আছে। বেশ তবে তাই থাকল। এত বছরে এত লোক ঢুকছে বেরচ্ছে, কই কেউ তো একবারের জন্য ঘুরে এসে বলছে না মঞ্চের অন্যদিকটা কেমন? তার নিশ্চিত কোন কারণ আছে। আর কিছু না-জানা থাকলেই ভয় জমতে থাকে। সেখানে নানা ব্যবসায়ী তাঁদের মতো করে ভয় দেখায় যাতে তাদের দুটো রোজগার হয়।

আমি কে?

শেষের দিনে প্রশ্নটা অধরাই থাকল, আমি কে? আমার শরীরটা কি আমি? নিশ্চই তা নয়। তা না হলে, কেন বলি “আমার শরীরটা ভালো নেই”? আমার জামা, আমার জুতোর মতোই আমার শরীর। তাই আমি আর আমার জামা বা জুতো যেমন একজন নই, আমি আর আমার শরীরও আলাদা। কেমন হল তো? সেই কাক্কেশ্বরের হিসেবের মতো হল কি? তার মানে আমার শরীরটা যদি আমি না হলাম, তবে আমি কে? হতে পারে আমি এই শরীরটার মধ্যে থাকি। কিন্তু আমি যে শরীরটা নই, তা তো বোঝাই যাচ্ছে। তা পরজন্ম থাকলেও নেই, না থাকলেও নেই।

অন্যদিকে সম্পর্কের সূত্র ধরা যাক। আমার সন্তানের পিতা কি আমি? স্ত্রীর স্বামী, পিতা মাতার সন্তান? যাঁরা আত্মা-তত্বে বিশ্বাসী, তাঁরা বলবেন আত্মার একটা আধার দরকার, সেই কারণে একজন পিতা মাতাকে প্রয়োজন। প্রকৃতির নিয়মে একটি সম্পূর্ণ স্বাধীন সত্ত্বাকে তাঁরা ধারন করেছেন। এই স্বাধীন স্বত্ত্বাটির স্বরূপ কি? তিনি কোথায় থাকেন? জন্ম নেবার আগে ও পরে তাঁর অস্তিত্ব কেমন? লাল, হলুদ না গোলাপী? পৃথিবীর বুকে প্রায় চুরাশি হাজার জীব প্রজাতি আছে। তাদের মধ্যে একমাত্র মানুষ উপার্জন করে খায়। অন্যরা তেমন কিছু করে না। অথচ তারা কেউ না খেয়ে নেই। খেতে গিয়ে কাজ করতে হয়, কাজ করতে গিয়ে অবয়ব তৈরি হয়। সেই অবয়ব তখন আমার পরিচয় হয়ে চেপে বসে। উনি ডাক্তার, তিনি পুলিশ, সে দোকানদার এমন নানা রকমের কাজ আর নানা রকমের পরিচয়। তবে সে যে মানুষ, সেই ঘটনাটা গেল হারিয়ে। অতঃপর তিনি বৃদ্ধ হলেন, তাঁর শরীর থেকে ঝরে পড়ল পেশাগত মুখোশ। ব্যাস আর যায় কোথায়, ডাক্তার পুলিশ দোকানদার সব মিশে গেল। কখনও কখনও তাঁরা বিশ্বাস করতে চান না, কি শো শেষ হয়ে গেছে, মনে মনে নকল দাড়ি গোঁফ লাগিয়ে সংলাপ বলে যান। মধ্যিখান থেকে হারিয়ে যায় আমার আসল আমি-টা।

আর কে চিনবে?

বড্ড গোলমাল বাধালে দেখছি। আচ্ছা একটু ওপর থেকে ভাবা যাক। এক্কেবারে ফাঁকা একটা জায়গা। অতীব অন্ধকার, বাতাস নেই, ধুলো নেই, কিচ্ছু নেই। সে এক অভাবনীয় নেই-রাজ্য। সেখানে অতিকায় পাথুরে, ধাতব, গ্যাসীয় গোলা। একটা দুটো নয়, কোটি কোটি তে। চিন্তার পরিধির সবচেয়ে বড় সংখ্যাটার চেয়েও বড়। পেল্লায় তার আকার। কেউ কেউ আবার খুব গরম, সততঃ প্রজ্জ্বলিত আগুন। কেউ কেউ হিম হিম শীতল ঠান্ডা। আর অমন অতিপ্রাকৃত পরিবেশে এই রাক্ষুসে গোলারা বাঁই বাঁই করে ঘুরে চলেছে। কে ঘোরায়, কেনই বা ঘোরায়? তাই যদি হয় সেখানে, আমরা তার তুলনায় তো ধুলোর চেয়ে ক্ষুদ্র। আর আমদের রণ রক্ত সফলতা কোন পরিমাপেই আসেনা। তবে কি ধরে দিনগুলো কাটাবো? যেটাই করি, তাতে গোলমাল এসে যায়। ওই অত কোটি কোটি গোলকের মধ্যে এই পৃথিবী নামক গোলকটিতে এমন কেন হল বা কি করে হল? আর সেখানে হঠাৎ করে নিজের অস্তিত্ব আবিস্কার করে এমন আহ্লাদিত হবার কি হল?  অত দূর পর্যন্ত, যখন একান্ত পৌঁছানো যাচ্ছেনা, তখন এটুকুই সই। চোখ মেলে তাকাই, কান ভরে গান শুনি। আর ভাব করি ক্ষণস্থায়ী সহযাত্রীদের সাথে, তারা শুধু যে মানুষ তা নন, আরো যারা রয়েছে। এই পৃথিবী তাদেরও বাড়িঘর। প্রজাপতি, পাখি, পশু, পোকা মাকড় এদেরও সমান অধিকার। প্রত্যেকের নিজের নিজের মঞ্চসময় নির্দিষ্ট করা আছে। অভিনয় সাঙ্গ হলে বেরিয়ে যাওয়া দস্তুর। আবার ঢুকতে হবে কি না জানা নেই, তাই যতটুকু হাততালি এই সময়ের কাজের জন্য বরাদ্দ। উইঙস পার করে গেলে, ধরাচূড়া খসে গেলে আর কে চিনবে?

[প্রথম প্রকাশঃ খোলমকুচি ব্লগ, সেপ্টেম্বর ২০১৬, https://howladersourav.blogspot.com/ ]

Facebook Comments Box

আমি ইমেল-এ খবরাখবর পেতে আগ্রহী